
একসময় শিশুরা স্কুল শেষে খেলাধুলা, বই পড়া বা বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাত। কিন্তু আজকের শিশুরা মাঠ নয়, সময় কাটাচ্ছে ইউটিউব স্ক্রিনে। অভিভাবকেরা মনে করেন, কার্টুন বা গান দেখা ক্ষতির কিছু নয়। কিন্তু গবেষণা বলছে, ইউটিউবের কিছু জনপ্রিয় চ্যানেল আসলে শিশুদের মানসিক ও সামাজিক বিকাশের জন্য মারাত্মক হুমকি।
ইউটিউবে কোথায় লুকিয়ে আছে বিপদ?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিশুদের উপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, ইউটিউবের অনেক চ্যানেল শিশুদের মধ্যে
- মনোযোগের ঘাটতি,
- অস্থিরতা,
- চট করে রেগে যাওয়া,
- হিংস্র আচরণ,
- বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যাওয়া—
এমন নানা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ চ্যানেলগুলো
- ChuChu TV
- Cocomelon
- Diana and Roma
- Vlad and Niki
- Little Baby Bum
- Morphle
- Elsa-Spiderman Parody
এসব চ্যানেলে রয়েছে অতি উজ্জ্বল রং, অস্বাভাবিক দ্রুত এডিট, চিৎকার-চেঁচামেচি, বিলাসিতার প্রদর্শন এবং অবাস্তব কাহিনি। শিশুরা এগুলোর প্রতি দ্রুত আসক্ত হয়ে পড়ে।
বাস্তব ঘটনা
ঢাকার মিরপুরের এক গৃহিণী বলেন,
“আমার চার বছরের ছেলে রাতে ঘুমাতে চায় না। ইউটিউবে Cocomelon না দেখালে কান্নাকাটি করে। স্কুলে পড়াশোনায় মনোযোগ দিচ্ছে না।”
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এটা আসলে “স্ক্রিন অ্যাডিকশন”। শিশুদের মস্তিষ্ক এখনও বিকাশমান, তাই রঙিন, দ্রুতগতির ভিডিও সহজেই তাদের স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে।
ইউটিউবে কী দেখাবেন শিশুদের?
সব চ্যানেল যে ক্ষতিকর, তা নয়। ইউটিউবে রয়েছে অনেক শিক্ষামূলক ও নিরাপদ চ্যানেল। এগুলো শিশুদের শেখার আগ্রহ বাড়ায়, ভাষা দক্ষতা উন্নত করে এবং নৈতিকতা শেখায়।
শিশুদের জন্যে সেরা ২২ টি শিক্ষামূলক ইউটিউব চ্যানেল লিঙ্ক
ইউটিউবে শিক্ষামূলক নিরাপদ চ্যানেল
- Peep and the Big Wide World
- Blippi
- Sesame Street
- Ms. Rachel
- Super Simple Songs
- National Geographic Kids
- SciShow Kids
এসব চ্যানেল শিশুদের প্রশ্ন করা, জানা, বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ এবং ভালো আচরণ শেখায়।
ইউটিউবে ইসলামিক শিক্ষা দেওয়া চ্যানেল
যেসব অভিভাবক চান তাদের সন্তান ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ শিখুক, তাদের জন্যও রয়েছে নিরাপদ ইউটিউব চ্যানেল। যেমন—
- Omar & Hana → মা-বাবার কথা শোনা, নামাজ ও দোয়া শেখায়।
- Mini Muslims → সালাম দেওয়া, সৎভাবে চলা শেখায়।
- Lia Chacha → বন্ধুদের সাহায্য, সত্য বলা শেখায়।
ইউটিউব নিয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
- শিশুদের ইউটিউব দেখার সময় সীমিত করুন।
- YouTube Kids অ্যাপে Parent Control চালু করুন।
- শিশুর পাশে বসে ভিডিও দেখান এবং তাদের সঙ্গে আলাপ করুন।
- প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৩০-৪৫ মিনিটের বেশি ইউটিউব না দেখতে দিন।
- নিয়মিত Watch History চেক করুন।
- অনুপযোগী কনটেন্ট Block বা “Not Interested” মার্ক করুন।
শিশুদের জন্য ইউটিউব নিরাপদ রাখবেন যেভাবে
আজকের দিনে প্রায় প্রতিটি শিশু ইউটিউব দেখে। কিন্তু ইউটিউবে শিশুদের জন্য যেমন শিক্ষামূলক ভিডিও, কার্টুন, গান, গল্প আছে, তেমনি আছে অনেক অপ্রয়োজনীয় ও অনুপযুক্ত কনটেন্টও। ইউটিউব শর্টস, বিজ্ঞাপন, গেমিং বা প্রাপ্তবয়স্ক ভিডিওতে শিশুরা অজান্তেই ঢুকে পড়তে পারে, যা তাদের মানসিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর।
আপনি কী জানতেন? শিশুরা যা দেখে, তাই তাদের মনে গেঁথে যায়। ভুল কনটেন্ট দেখলে তাদের মনোজগৎও ভুলভাবে গড়ে উঠতে পারে। তাই আজই সিদ্ধান্ত নিন—আপনার সন্তান কী দেখবে আর কী দেখবে না।
- এক পাশে ক্ষতিকর চ্যানেলের নাম ও প্রভাব,
- অন্য পাশে ভালো চ্যানেল ও তাদের শেখার বিষয়।
এতে করে অভিভাবকেরা এক নজরে বুঝতে পারবেন কোনটা এড়িয়ে চলা উচিত, আর কোনটা শিশুর জন্য ভালো।
তাহলে অভিভাবক হিসেবে আমরা কীভাবে ইউটিউবকে শিশুদের জন্য নিরাপদ রাখতে পারি? চলুন কিছু কার্যকর কৌশল জানি।
১. অপ্রয়োজনীয় কনটেন্ট ব্লক করে দিন
শিশুরা প্রায়ই নতুন ভিডিওতে ক্লিক করে চলে যায়। তাই যেসব চ্যানেল বা ভিডিও অনুপযোগী, সেগুলো ব্লক করা জরুরি।
কীভাবে করবেন:
- ভিডিওর ডান পাশে থাকা থ্রি-ডট মেনুতে ক্লিক করুন।
- “Block” বা “Not Interested” অপশন সিলেক্ট করুন।
- এরপর একই ধরনের ভিডিও আসা কমে যাবে।
উদাহরণ: যদি শিশুদের গেমিং ভিডিও দেখতে চান, কিন্তু হঠাৎ প্রাপ্তবয়স্ক ভাষা ব্যবহার করা ভিডিও আসে, সেটি ব্লক করে দিলে ভবিষ্যতে আর সে ধরনের ভিডিও আসবে না।
২. সার্চ ডিজেবল করে রাখুন
শিশুরা অনেক সময় নিজে থেকে সার্চ দিয়ে এমন ভিডিও খুঁজে ফেলে যা তাদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
কীভাবে করবেন:
- শিশুদের জন্য শুধুমাত্র নির্দিষ্ট চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করে রাখুন।
- সার্চ অপশন ডিজেবল করে দিন।
উদাহরণ: আপনি যদি ChuChu TV, Cocomelon, বা Infobells Bangla সাবস্ক্রাইব করে রাখেন, তাহলে শিশু কেবল ওই চ্যানেলগুলোর ভিডিও দেখতে পারবে।
৩. ওয়াচ হিস্ট্রি নিয়মিত চেক করুন
শিশু কোন ভিডিওগুলো দেখছে তা জানার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ওয়াচ হিস্ট্রি।
কীভাবে করবেন:
- YouTube অ্যাকাউন্টে গিয়ে “History” অপশনে যান।
- দেখুন শিশু সাম্প্রতিক সময়ে কী ধরনের ভিডিও দেখেছে।
উদাহরণ: আপনি হয়তো দেখলেন শিশু এক ঘণ্টা ধরে শুধুই শর্টস ভিডিও দেখছে। তখন তাকে বুঝিয়ে শর্টস ব্যবহারের সময় কমাতে পারেন।
৪. রেস্ট্রিক্টেড মোড চালু করুন
YouTube-এ রেস্ট্রিক্টেড মোড চালু করলে অপ্রয়োজনীয় ভিডিও আসা অনেকটাই কমে যায়।
কীভাবে করবেন:
- YouTube অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে গিয়ে Settings → General → Restricted Mode চালু করুন।
উদাহরণ: যদি আপনার শিশু কার্টুন খুঁজে, তবে প্রাপ্তবয়স্ক বিষয়বস্তু সেখানে আর দেখাবে না।
৫. “Not Interested” অপশন ব্যবহার করুন
যদি কোনো ভিডিও ফিডে আসে যা আপনি চান না, সেটিকে “Not Interested” করে দিন।
উদাহরণ: আপনি চান না শিশু “হরর” বা “ভায়োলেন্স” ভিডিও দেখুক। কিছুদিন “Not Interested” চাপলে ইউটিউব অ্যালগরিদম বুঝবে এবং এগুলো আর দেখাবে না।
৬. YouTube Kids ব্যবহার করুন
শিশুদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম হলো YouTube Kids। এখানে কেবল শিশুদের উপযোগী কনটেন্ট থাকে।
সুবিধা:
- প্রাপ্তবয়স্ক ভিডিও নেই।
- বয়সভিত্তিক কনটেন্ট সাজানো থাকে।
- অভিভাবকরা ভিডিও কাস্টমাইজ করতে পারেন।
উদাহরণ: ৩–৬ বছরের শিশুদের জন্য শুধু কার্টুন ও গান দেখানো যাবে, আবার ৭–১২ বছরের শিশুদের জন্য শিক্ষামূলক ভিডিও ও গল্প।
৭. শিশুর সাথে একসঙ্গে ভিডিও দেখুন
শিশুরা একা ইউটিউব দেখলে নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে যায়। তাই সময় বের করে তার সাথে বসুন।
উদাহরণ: শিশুটি “Numberblocks” দিয়ে সংখ্যা শিখছে। আপনি পাশে বসে তাকে সংখ্যার খেলা শেখাতে পারেন। এতে তার শেখা দ্রুত হবে এবং আপনাদের মধ্যে সম্পর্কও মজবুত হবে।
৮. শিশুকে বুঝিয়ে বলুন
শিশুর সাথে খোলামেলা আলোচনা করুন। তাকে বোঝান কেন কিছু ভিডিও তার জন্য ক্ষতিকর।
উদাহরণ: যদি সে হিংসাত্মক কার্টুন দেখে, আপনি বোঝাতে পারেন বাস্তব জীবনে এসব করা ঠিক নয়।
৯. ইউটিউব শর্টস বন্ধ রাখুন
YouTube Shorts অনেক সময় আসক্তি তৈরি করে। যদিও সরাসরি শর্টস বন্ধ করার অপশন নেই, তবে পুরোনো ভার্সন ব্যবহার করলে শর্টস দেখা যায় না।
উদাহরণ: যদি আপনার শিশু প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা শর্টস দেখে, তবে বিকল্প অ্যাপ (যেমন YouTube Kids) ব্যবহার করতে দিন।
১০. প্রয়োজনে অ্যাপ ব্লক করে দিন
সব চেষ্টা করেও যদি মনে হয় ইউটিউব ক্ষতিকর হচ্ছে, তবে অ্যাপটি ব্লক করে দিতে পারেন।
উদাহরণ: অ্যান্ড্রয়েডে “Digital Wellbeing” ব্যবহার করে ইউটিউব অ্যাপ ব্লক করা যায়।
শেষ কথা
ইউটিউব শিশুদের জন্য যেমন শেখার দারুণ প্ল্যাটফর্ম, তেমনি সঠিক নিয়ন্ত্রণ না থাকলে হতে পারে ক্ষতিকর। তাই অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। ব্লক, রেস্ট্রিক্টেড মোড, YouTube Kids, ওয়াচ হিস্ট্রি—এসব ব্যবহার করলে ইউটিউবকে অনেকটাই নিরাপদ রাখা সম্ভব।
