বিদেশে উচ্চশিক্ষা – জেনে নিন কীভাবে প্রস্তুত হবেনঃ
একসময় বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সচ্ছলতাই মুল বিষয় ছিল। কেবল উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তানেরাই এ নিয়ে ভাবত। কিন্তু বর্তমান চিত্র একদম ভিন্ন! বিভিন্ন দেশের শিক্ষার মান, সুযোগ সুবিধা, চাহিদা ইত্যাদি বিষয় প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। তাই আপনাকে সবসময় আপডেটেট থাকা জরুরি। আপনি হয়তো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছরের চাহিদা অনুযায়ী একটা আবেদন করলেন, কিন্তু এ বছর তা পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। আপনি এর ফলে সুযোগ হারাতে পারেন। আবার হয়ত গত বছর আপনার কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে স্কলারশিপ ছিল না, যা এ বছর আছে। তাই না জানার কারণে আপনি বিদেশে উচ্চশিক্ষা সুযোগ হারাতে পারেন। সেজন্য নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন অনলাইনে এবং চোখ রাখুন বিভিন্ন ওয়েবসাইটে।
ইংরেজি দক্ষতা যাচাই
স্যাট, জিআরই, জিম্যাট, আইইএলটিএস অথবা টোয়েফল পরীক্ষা দিয়ে ফেলুন। বিদেশে উচ্চশিক্ষায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা প্রকাশের জন্য স্যাট, জিআরই বা জিম্যাট স্কোরকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ ছাড়া ভাষা-দক্ষতার প্রমাণ হিসেবে আইইএলটিএস ও টোয়েফল স্কোরের গুরুত্বও অনেক। এই পরীক্ষাগুলোর জন্য সময় দিয়ে, কঠোর পরিশ্রম করে, যত বেশি সম্ভব স্কোর তুলতে হবে। আপনি যদি নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে চান, তবে গুরুত্বপূর্ণ কোর্স করে রাখুন। কাজে আসবে। অনেকে মনে করে, বাইরে না যেতে পারলে IELTS বা TOEFL করে লাভ কী? কিন্তু এসব জ্ঞান আপনার দেশেও চাকরি বা ব্যক্তিগত জীবনেও উপকারে আসবে। তাই নিজেকে যতটুকু সম্ভব প্রস্তুত রাখুন সব সময়।
স্কলারশিপের খোঁজ-খবর রাখুন
বাংলাদেশ শিক্ষামন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে কোথায় কোন প্রতিযোগিতা হচ্ছে, কোথায় ভলান্টিয়ার লাগবে, কোন কোন প্রতিষ্ঠানে পেইড ইন্টার্ন নিচ্ছে এবং স্কলারশিপের খোঁজ-খবর দেয়া হয়। আপনারা চাইলে কোন কোন দেশে স্কলারশিপ দেওয়া হচ্ছে, তাদের ওয়েবসাইটে যেয়ে ঘুরে আসতে পারেন।
বাংলাদেশ শিক্ষামন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট : https://moedu.gov.bd/
স্কলারশিপ পাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের টার্গেট কান্ট্রি থাকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, চীন, জার্মানি, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং রাশিয়া।এইসকল দেশের স্কলারশিপ সংক্রান্ত খোঁজখবর মিলবে তাদের অফিশিয়াল ওয়েবসাইগুলোতে। যুক্তরাজ্যে পড়াশোনার তথ্যের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইটের লিংক হল –
যুক্তরাজ্যের অনুমোদিত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকা পাবেন এই লিংকে- https://www.gov.uk/browse/visas-immigration/student-visas অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য পাবেন- http://studyinaustralia.gov.au সাইটে। কানাডায় উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয় তথ্য মিলবে www.cic.gc.ca/english/information/applications/student.asp
এছাড়াও ঢাকার এইসব দেশের দূতাবাসে গেলেও প্রয়োজনীয় সব তথ্যই পাওয়া যাবে।
বিশ্ববিদ্যালয়, বিভাগ আর সেশন ঠিক করে নিতে হবে
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদন করার ধরন ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে আলাদা। দেশের বাইরে পড়ালেখার পরিকল্পনা থাকলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন। আবেদনের শেষ দিন, কী কী কাগজপত্র পাঠাতে হবে, খরচ কেমন ইত্যাদি জেনে, বুঝে নিন। কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোন বিষয়টি আপনার জন্য মানানসই। সাধারণত মার্চ ও অক্টোবর মাসের মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করতে হয়। কয়েকটি সেশনে ভর্তি করা হয়, এ ক্ষেত্রে কোন সেশনে ভর্তি হতে চান, সে পরিকল্পনাও করে ফেলুন।
মূল সনদ জোগাড় করে রাখুন
শিক্ষা বোর্ড বা কলেজ থেকে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার মূল নম্বরপত্র ও সনদ সংগ্রহ করে রাখুন সময়মত। স্নাতকোত্তরে আবেদনের জন্য অনার্সের নম্বরপত্র আর সনদ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিস থেকে সংগ্রহ করতে হয়। ইউরোপ-আমেরিকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়-নির্ধারিত খামে সনদ পাঠাতে হয়, সেদিকেও আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে।
পাসপোর্ট তৈরি রাখুন
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদনের সময় অনেক ক্ষেত্রে পাসপোর্ট নম্বর প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া স্যাট, জিআরই, জিম্যাট, আইইএলটিএস, টোয়েফল পরীক্ষা দিতেও পাসপোর্ট কাজে লাগে। পাসপোর্ট না থাকলে তৈরি করে ফেলতে হবে। এবং মেয়াদ ছয় মাসের কম থাকলে নতুন করে বানাতে হবে। পাসপোর্টে নামের বানান যেন মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক সনদের মতোই হয় সে দিকে খেয়াল রাখবেন। বানানের গরমিলের কারণে অনেকেই ভর্তি বা বৃত্তির আবেদন করতে পারেন না।
এলওআর, এসওপি, এলওআই তৈরি করুন
বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে এলওআর, এসওপি ও এলওআই শব্দগুলো পরিচিত টার্মস। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা একাডেমিক ক্ষেত্রে খুব আলোচিত ব্যক্তির কাছ থেকে আপনাকে ‘লেটার অব রিকমেন্ডেশন’ বা এলওআর সংগ্রহ করতে হবে। সাধারণত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এলওআরের ধরন বিভিন্ন থাকে, যা আপনি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করে নিতে পারবেন। যে বিষয়ে বা বিভাগে আপনি আবেদন করবেন তা কেন আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সম্ভাব্য গবেষণার বিষয় কি, কীভাবে গবেষণা করতে আগ্রহী, কিসে আপনার আগ্রহ—এসব নিয়ে ‘স্টেটমেন্ট অব পারপাস’ বা এসওপি এবং ‘লেটার অব ইন্টারেস্ট’ বা এলওআই লিখতে হয়। এই দুটি পত্র লেখার সময় শতভাগ নিজের মতো করে লিখতে হবে। অন্য কোথাও থেকে ‘কাট-কপি-পেস্ট’ কোনোভাবেই করা যাবে না। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নিজের ভাষায় এই পত্র লিখতে হবে। যতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনি আবেদন করবেন তার জন্য আলাদা আলাদা এলওআর, এসওপি ও এলওআই তৈরি করতে করবেন।
অন্যান্য সনদ সংগ্রহ করে ফেলুন
বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আবেদনের সময় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে কাজের অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার ও অংশগ্রহণের সনদ বেশ গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। এ ধরনের সনদ আবেদনের সাথে জমা দিতে হয়।
শেষ সময়ের আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন পাঠাতে হবে
অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের ক্ষেত্রে শেষ তারিখের প্রায় ২০-২৫ দিন আগেই আবেদনপত্র কুরিয়ারে পাঠাতে হয়। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে আবেদনপত্র পাঠাতে একেক সময় লাগে, এ ক্ষেত্রে হাতে সময় নিয়ে আপনাকে কুরিয়ার করতে হবে।
সনদ সত্যায়িত করা
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের সাথে মূল সনদের সত্যায়িত কপি জমা দিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে এই সনদ সত্যায়িত করতে হবে। নকল সত্যায়ন করলে আপনার ভর্তি-প্রক্রিয়া যেকোনো সময় আটকে যেতে পারে।
নেটওয়ার্কিং করুন
বিদেশে পড়তে যাওয়ার ক্ষেত্রে নেটওয়ার্কিং করা জরুরি। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে ইচ্ছুক সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সংগঠনসহ ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ থেকে তথ্য-সহযোগিতা নিতে পারেন।
সঠিক উপায়ে সময়মত প্রস্তুতি গ্রহণ করুন
বিদেশে উচ্চশিক্ষা প্রস্তুতি গ্রহণের ক্ষেত্রে আপনাকে নিতে হবে উদ্যোগ। সেক্ষেত্রে আপনাকে একাডেমিক রেজাল্টের পাশাপাশি এক্সট্রা কারিকুলামের দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। আপনি বিভিন্ন ভলেন্টিয়ারিং কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্টতা বৃদ্ধি করুন। এই সকল সহশিক্ষা কার্যক্রম আপনাকে বাইরের দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। ভালো স্কলারশিপ পেতে হলে আপনাকে রেজাল্ট এর দিকে নজর দিতে হবে। তাই একাডেমিক রেজাল্ট অন্তত ৩.৫০ এর মধ্যে রাখার চেষ্টা করুন। কারণ রেজাল্ট ভালো হলে স্কলারশিপ পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় অনেক। অনেকেই কোন দেশে আসবেন, এটা নিশ্চিত থাকেন না, বিষয় তো দূরের কথা। কিন্তু বিদেশে উচ্চশিক্ষা মেধা দিয়ে অর্জন করে নিতে হয় তাই প্রথমেই লক্ষ্য নির্ধারণ করুন।
রিসার্চ পেপার
বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে রিসার্চ পেপার। আপনি যদি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে যান সেক্ষেত্রে আপনার রিসার্চ পেপার পাবলিশ থাকলে ভালো স্কলারশিপ খুব সহজে পেয়ে যাবেন। জার্নাল, আর্টিকেল কিংবা নিউজ পেপারে আপনি যদি লেখালিখি করেন এবং তার পাবলিশ লিংক আপনার ডকুমেন্ট এর সাথে পাঠিয়ে দেন তাহলে আপনি কম সিজিপিএ থাকলেও একটি ভালোমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ করতে পারবেন।
সময়ের সদ্ব্যবহার করুন
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি ও স্কলারশিপের সময়সীমা নির্দিষ্ট, যা মেনে চলা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সবসময় প্রয়জনিয় কিছু জিনিস প্রস্তুত রাখুন। যেমন CV, Motivation Letter, Recommendation Letter ইত্যাদি।
বাজেট বা অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে ভাবুন
আপনার পক্ষে কতটুকু ব্যয় করা সম্ভব, তা জেনে আবেদন করুন। কারণ, সময়মত না ভেবে আবেদন করলে পরে আর্থিক সমস্যার কারণে ভেস্তে যেতে পারে। বাজেট করুন এবং সে অনুযায়ী সামনে এগোন। এলোমেলো প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে পারে।
বিভ্রান্ত হবেন না
আপনি যদি আত্মবিশ্বাসী হন, কেউ আপনাকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না। তাই আত্মবিশ্বাস খুবই জরুরি। আপনার যোগ্যতা থাকলেই কেবল আপনি এডমিশন এবং ভিসা পাবেন।