
মায়ের বুকের দুধ শিশুর প্রথম ও পরিপূর্ণ খাবার। এতে সব ধরনের পুষ্টি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও আবেগিক সুরক্ষা থাকে। তবে অনেক নতুন মা জানেন না, কীভাবে ও কত সময় পরপর শিশুকে দুধ খাওয়ানো উচিত। নিচে দেওয়া হলো বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম:
শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সঠিক নিয়ম ও অবস্থান
মা ও শিশুর মাঝে ভালোবাসা ও পুষ্টির সেরা বন্ধন হলো বুকের দুধ। শিশুর জন্মের পর থেকে প্রথম ছয় মাস শুধু মায়ের দুধই তার জন্য যথেষ্ট। তবে অনেক নতুন মা বুঝতে পারেন না কীভাবে শিশুকে সঠিকভাবে দুধ খাওয়াতে হয়। নিচে দেওয়া হলো বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় সঠিক পজিশন, লক্ষণ ও গুরুত্বপূর্ণ টিপস।
শিশুর স্বাভাবিক প্রবৃত্তি
শিশুরা জন্ম থেকেই মায়ের স্তন খুঁজে নিতে পারে, কিন্তু সঠিকভাবে স্তন্যপান করতে মা ও শিশুর অনুশীলন ও সময় দরকার হয়। অনেক সময় মা’কে শিশু সঠিকভাবে অবস্থান নিতে সাহায্য করতে হয় যাতে সে আরাম করে দুধ খেতে পারে।
বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় যেসব লক্ষণ ঠিক আছে কিনা দেখে নেবেন:
✔️ সঠিক সংস্থাপন বা ল্যাচিং (latching) বোঝার উপায়:
- স্তন্যপানে কোনো ব্যথা হবে না
- শিশুর মুখে অ্যারিওলার (স্তনবৃন্তের কালো অংশ) বেশিরভাগ ওপরে দেখা যাবে
- শিশুর মুখ বড় করে খোলা থাকবে
- নিচের ঠোঁট সামান্য উল্টে থাকবে
- থুতনি মায়ের স্তন ছুঁয়ে থাকবে
✔️ সঠিক অবস্থান বোঝার উপায়:
- শিশুর মাথা, গলা ও শরীর এক সরল রেখায় থাকবে
- শিশু আপনার শরীরের খুব কাছে থাকবে
- পিঠ বরাবর পুরো শরীরের সাপোর্ট দিন
- শিশুর নাক বরাবর স্তনবৃন্ত ধরুন
✔️ সঠিকভাবে দুধ খাওয়ানো হচ্ছে কিনা বুঝবেন যেভাবে:
- শিশু গভীরভাবে চুষে দুধ খায়, মাঝে মাঝে বিরতি নেয়
- ঢোক গেলার শব্দ শোনা যায়
- খাওয়ার পর স্তন হালকা লাগে
- শিশুর মুখে সন্তুষ্টির ছাপ থাকে, ঘুমিয়ে পড়তে পারে
বুকের দুধ খাওয়ানোর ৫টি জনপ্রিয় ও কার্যকর পজিশন
১. ক্রাডল হোল্ড (Cradle Hold)
- মা’র কনুইয়ের ভাঁজে শিশুর মাথা
- শিশুর মুখ ও বুক মায়ের স্তনের সামনে
- আরামদায়ক চেয়ার বা বালিশ ব্যবহার করুন
২. ক্রস ক্রাডল হোল্ড (Cross-Cradle Hold)
- নতুন মায়েদের জন্য আদর্শ
- বিপরীত হাত দিয়ে শিশুর মাথা ধরে স্তনের দিকে আনা
- নিয়ন্ত্রণ বেশি, সঠিক ল্যাচিং সহজ
৩. ফুটবল হোল্ড (Football Hold)
- শিশুকে বাহুর নিচে ধরে স্তনের দিকে মুখ করে রাখা
- মায়েদের জন্য উপকারী যদি স্তন বেশি বড় হয় বা সিজার হয়েছে
- স্তনবৃন্তে ঘা থাকলে এই পজিশন আরামদায়ক
৪. সাইড লাইয়িং পজিশন (Side-lying Position)
- মা ও শিশু উভয়ে পাশ ফিরে শোয়ে দুধ খাওয়ানো
- রাতে বা বিশ্রামের সময় উপযোগী
- নিশ্চিত করতে হবে শিশুর নাক যেন ঢাকা না পড়ে
৫. রিক্লাইনিং পজিশন (Reclining or Laid-back Position)
- মা হেলান দিয়ে আধাশোয়া থাকবেন
- শিশু বুকের উপর থাকবে, চামড়ায় চামড়ার সংস্পর্শ থাকবে
- কোলিক বা অতিরিক্ত কান্না করা শিশুদের জন্য উপকারী
শারীরিক সংস্পর্শের উপকারিতা:
- শিশুর তাপমাত্রা, শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে
- হজম বাড়ায় ও সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়ক
- মা ও শিশুর মাঝে আবেগিক বন্ধন গড়ে তোলে
প্রয়োজনে সাহায্য নিন
যদি বুকের দুধ খাওয়াতে ব্যথা হয়, শিশু ঠিকমতো না খায় বা আপনি বিভ্রান্ত বোধ করেন, তাহলে ল্যাকটেশন বিশেষজ্ঞ, মিডওয়াইফ বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় মা যা খাবেন না

বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে আরও কিছু পরামর্শ
- শিশু জন্মের পর প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যেই তাকে মায়ের দুধ খাওয়ানো শুরু করা উচিত। এই প্রথম দুধকে বলে “কোলস্ট্রাম”, যা অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- প্রতিটি শিশুর ক্ষুধার পরিমাণ আলাদা। সাধারণত প্রতি ২–৩ ঘণ্টা পরপর খাওয়ানো উচিত। তবে, যদি শিশু কাঁদে, হাত চোষে বা ঠোঁট নাড়ে, বুঝতে হবে সে ক্ষুধার্ত।
- প্রতিটি স্তন থেকে গড়ে ১৫–২০ মিনিট করে দুধ খাওয়ানো উচিত, যাতে শিশুর প্রয়োজনীয় পুষ্টি মেলে এবং স্তনের দুধ পুরোপুরি খালি হয়।
- প্রথমে একটি স্তন থেকে খাওয়ান, পরের দফায় অন্য স্তন দিন। এতে দুটো স্তনের দুধ সমানভাবে উৎপন্ন হয় এবং স্তনের সমস্যাও কমে।
- শিশু যেন মা’র স্তনের মুখ পুরোপুরি ধারণ করতে পারে (latching ঠিকমতো)
- শিশুর মাথা, গলা ও শরীর যেন এক সরল রেখায় থাকে
- মা যেন আরামদায়ক অবস্থানে থাকেন (পিঠে বালিশ ব্যবহার করতে পারেন)
- দুধ খাওয়ানোর পর শিশুকে কাঁধে রেখে ৫–১০ মিনিট হালকা পিঠে চাপ দিয়ে ডাকাতে সাহায্য করুন। এতে বাতাস বের হয়ে যায় এবং পেটের গ্যাস কমে।
- কখনোই শিশুকে শোয়ানো অবস্থায় দুধ খাওয়াবেন না (choking হতে পারে)
- যদি দুধ না আসে বা শিশুর ওজন না বাড়ে, চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ নিন
- শিশুর প্রস্রাবের পরিমাণ ও ঘুম পর্যবেক্ষণ করুন
ডাক্তার কী বলেন?
বিশেষজ্ঞরা বলেন, শুধু বুকের দুধই প্রথম ৬ মাস শিশুর জন্য যথেষ্ট। পানি, মধু বা অন্য কোনো খাবার দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এমনকি তা ক্ষতিকরও হতে পারে।
মায়ের দুধ শিশুর জীবনের প্রথম “টিকা” – যা তাকে সুস্থ রাখে, ভালোবাসা দেয় এবং নিরাপত্তা তৈরি করে।