মেডিকেল

জরায়ুমুখ ক্যানসার কী? লক্ষণ, চিকিৎসা, ঝুঁকিসমূহ, প্রতিরোধের উপায় ও প্রতিষেধক

বাংলাদেশে প্রতি বছর জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হওয়া সত্ত্বেও এই রোগ নিয়ে অনেকেরই খুব একটা ধারণা নেই।

জরায়ুমুখ ক্যানসার কী? (Cervical Cancer)

সার্ভিক্স হলো নারী দেহের জরায়ুর নিচের দিকের অংশ, যা যোনি এবং জরায়ুকে সংযুক্ত করে। যখন এই স্থানের কোষগুলো অস্বাভাবিকভাবে পরিবর্তন হতে শুরু করে তখন তা ক্যানসারে রূপ নেয়। অনেক সময় ক্যানসার সার্ভিক্স থেকে শুরু হয়ে ফুসফুস, যকৃত, মূত্রথলি, যোনি, পায়ুপথেও ছড়িয়ে যেতে পারে।

জরায়ুমুখ ক্যান্সার হয় এক ধরনের ভাইরাসের আক্রমণে, যার নাম হল ‘হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস’। এঈ রোগ ছড়ায় ওই ভাইরাস আছে এমন কারও সঙ্গে মিলনের মাধ্যমে। মিলনের সময় পুরুষের কাছ থেকে নারীদেহে এই ভাইরাস ঢুকে যেতে পারে। ভাইরাসটি ঢোকার সাথে সাথেই ক্যানসার হয় না, বেশ কয়েক বছর সময়ও লাগতে পারে। গবেষক ও চিকিৎসকরা বলছেন, ভাইরাসের জীবাণু প্রবেশের পর ১৫ থেকে ২০ বছরও সময় লাগে জরায়ুমুখের ক্যান্সার হতে। তাই এটি নির্ণয়ে অনেকটা সময় পাওয়া যায়। তাই প্রয়োজন নিয়মিত স্ক্রিনিংয়ের । যখন নারীর শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, তখনই এই ভাইরাসটি নারী দেহে ক্যানসার রোগের সৃষ্টি করে।

https://bangla.minciter.com/2020/11/10/%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%a8-%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%ac%e0%a6%be-%e0%a6%ac%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a7%87%e0%a6%b8%e0%a7%8d/

যে কারণে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের চিকিৎসায় নিয়মিত পরীক্ষা জরুরি

জরায়ু ক্যান্সারকে বলা হয়ে থাকে ‘নীরবঘাতক’। জরায়ুমুখের ক্যানসারের মূল সমস্যাটি হলো এটি শেষ পর্যায়ে গেলেই শুধুমাত্র ব্যথা বোঝা যায়। এর আগের লক্ষণগুলো মাসিকের মেয়েলি সমস্যা বলে ধারনা করেন অনেকে। ক্যানসার যখন শেষ পর্যায়ে চলে যায়, তখন রোগটা অনেক দূর ছড়িয়ে যায়।

প্রাথমিকভাবে ব্যথা না থাকায় নারীরা চিকিৎসকের কাছে যান না। এমনকি লক্ষণ দেখা দেয়ার পরেও তারা অপেক্ষা করেন। দেখা যায় দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব যাচ্ছে কিন্তু লজ্জায় কাউকে বলছেন না বা স্বামীর সঙ্গে মেলামেশায় রক্ত যাচ্ছে সেটিও অনেক সময় বলছেন না। ফলে যখন হাসপাতালে যান তখন অনেক দেরি হয়ে যায়।

অথচ এতদূর পর্যন্ত এটি আসবার কথা নয়। কারণ অন্য ধরনের ক্যানসারের তুলনায় জরায়ুমুখের ক্যানসার সবচাইতে সহজে নির্ণয় করা যায়। এমনকি এই রোগ হওয়ার আগেই খুব সহজ একটি পরীক্ষায় ধরা যায় ক্যানসার হওয়ার আগের অবস্থা আছে কি না। এই পরীক্ষাকে বলে ভায়া টেস্ট। যৌন সম্পর্কে আছেন, এমন নারীরা ভায়া টেস্ট করে নিলেই জানতে পারবেন, তার জরায়ুমুখ ক্যানসার হওয়ার আগের অবস্থায় আছে কি না।

এছাড়া নিয়মিত ভায়া টেস্ট করালে ক্যানসার হওয়ার আগেই তা নির্ণয় করা সম্ভব হয়। এমনকি যদি কারও জরায়ুমুখ ক্যানসার হয়েও থাকে, প্রাথমিক অবস্থায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসা করলে তা ভালো হয়ে যেতে পারে।

জরায়ুমুখের ক্যানসার নির্ণয়ের পরীক্ষার প্রাথমিক ধাপ, অর্থাৎ ভায়া টেস্ট করানো অনেক সহজ। এঁটে কোনো ব্যথা লাগে না। সময়ও লাগে মাত্র এক মিনিট। যেসব নারীর বয়স ৩০ থেকে ৬০-এর মধ্যে রয়েছে, তাদের প্রতি পাঁচ বছর পরপর ভায়া টেস্ট করানো প্রয়োজন। ৩৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সী নারীরা সবচেয়ে বেশি এমন সার্ভিক্যাল ক্যানসারে আক্রান্ত হন।

যারা ঝুঁকিতে আছেন

  • বাল্যববিাহ। ১৬ বছর বয়স হওয়ার আগেই সংগমের অভিজ্ঞতা থাকলে বা পিরিয়ড শুরুর ১ বছরের মধ্যেই সঙ্গম শুরু হয়ে থাকলে।
  • কম বয়সে গর্ভধারণ এবং অধিক সন্তান প্রসব করা।
  • স্বামী বা সঙ্গীর শরীরে ভাইরাসটি থাকলে।
  • অনেকজন সঙ্গীর সাথে সহবাস হয়ে থাকলে।
  • জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য দীর্ঘদিন, বিশেষ করে ৫ বছরের বেশি সময় ধরে গর্ভনিরোধক ওষুধ সেবন করে থাকলে।
  • অপরিচ্ছন্ন থাকলে, মদ্যপান ও ধূমপানের অভ্যাস থাকলে।
  • শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে।
  • সংগমের মাধ্যমে ছড়ায় এমন কোনো রোগ থেকে থাকলে। যেমন–এইডস, সিফিলিস, গনোরিয়া, ইত্যাদি।
  • ৩৫ থেকে ৬০ বছর বয়সী নারীদের জরায়ুমুখ ক্যানসারের ঝুঁকি অনেক বেশি।

জরায়ুমুখ ক্যানসারের লক্ষণসমূহ:

  • অস্বাভাবিকভাবে রক্তপাত হলে। যেমন–সংগম পরবর্তী সময়ে, দুটি পিরিয়ডের মাঝামাঝি সময়ে, পিরিয়ড বা রজঃশ্রাব বন্ধ হবার পরে, শ্রোণিদেশের কোনো পরীক্ষার পরে।
  • যোনিদেশ থেকে অস্বাভাবিকভাবে কোনো পদার্থ বের হতে থাকলে।
  • দুর্গন্ধযুক্ত সাদা স্রাব হওয়া।
  • হঠাৎ করেই ওজন হ্রাস বা বৃদ্ধি হওয়া।
  • খাবারে অনীহা, বমি ভাব বা বমি হওয়া।
  • নিচের দিকে পেট ফুলে যাওয়া।
  • জরায়ুর চারপাশে চাপা লাগা এবং ঘন ঘন মূত্রত্যাগ করা।
  • প্রস্রাবে সমস্যা।
  • পা ফুলে যেতে থাকা।
  • কিডনি ফেইলিউর।
  • হাড়ে ব্যথা হওয়া।
  • দুর্বলতা অনুভব করা।

জরায়ুমুখ ক্যানসারের চিকিৎসা

জরায়ুমুখ ক্যানসারের চিকিৎসা বেশ কিছু বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। যেমন: ক্যানসারের স্টেজ, ক্যানসার শরীরের অন্য কোথাও ছড়িয়ে পড়েছে কি না, রোগীর বয়স, স্বাস্থ্যের অবস্থা ইত্যাদি। জরায়ুমুখ ক্যানসারের প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতি হলো: সার্জারি, রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি, টারগেটেড থেরাপি।

সার্জারি: ক্যানসার বেশি ছড়িয়ে না পড়লে অর্থাৎ প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলে সার্জারি করা যায়। এটি জরায়ুমুখ ক্যানসার চিকিৎসার একটি অংশ হতে পারে। এমন সার্জারিতে সাধারণত জরায়ুমুখের যে অংশে টিউমার আছে, সেই অংশসহ আশপাশের কিছু টিস্যু অপসারণ করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরো জরায়ুমুখ অপসারণ করা হয়। এক্ষেত্রে সার্জারির পরে রেডিয়েশন বা কেমোথেরাপি দেওয়া হয়।

কেমোথেরাপি: এ ক্ষেত্রে ওষুধ ব্যবহার করে ক্যানসারের কোষগুলোকে ধ্বংস করা হয়। কেমোথেরাপি সার্জারির আগে বা পরে দেয়া হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি একই সময়ে দেয়া হয়ে থাকে। যেসব রোগীর সার্জারি করানো সম্ভব হয় না, তাঁদের ক্ষেত্রে কেমোথেরাপিকে প্রধান চিকিৎসা হিসাবে ধরা হয়ে থাকে।

রেডিওথেরাপি: এ পদ্ধতিতে অতি শক্তিশালী এক্স-রের মাধ্যমে ক্যানসারের কোষকে ধ্বংস করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে রেডিওথেরাপি সার্জারির আগে দেয়া হয়ে থাকে, যাতে টিউমারকে খুব সহজেই অপসারণ করা যায়। সার্জারির পরে অবশিষ্ট ক্যানসারের কোষকে ধ্বংস করার জন্য রেডিওথেরাপি দেয়া হয়ে থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কেমোথেরাপির সঙ্গে রেডিওথেরাপিও দেয়া হয়ে থাকে।

জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধের উপায়

প্রতিষেধক ব্যবহার করে জরায়ুমুখ ক্যানসারের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। এছাড়া জরায়ুমুখ ক্যান্সারই একমাত্র ক্যান্সার যার টিকা আছে। মাসিক শুরুর পরপরই এবং যৌন সম্পর্ক শুরু কিংবা বিয়ের আগে টিকা নিলে এই ক্যান্সার থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব।

• সাধারণত ২০ বছর বা বিয়ের পর প্রতি তিন বছর পর পর প্যাপস্মেয়ার বা ভায়া টেস্ট করানো জরুরি।
• সহবাসের জন্য একজন সঙ্গী নির্বাচন করা এবং নিরাপদ ভাবে সহবাস করা।
• বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা এবং অল্প বয়সে গর্ভধারণ না করা।
• অধিক সন্তান প্রসব না করা।
• পরিচ্ছন্ন থাকা, ধূমপান, মদ্যপান থেকে বিরত থাকা।
• জন্মনিরোধক ওষুধ না খেয়ে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

কখন একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন?

পিরিয়ড বন্ধ পরেও রক্তপাত হওয়া কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এমনটি ঘটলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। পিরিয়ডের সময় অতিরিক্ত

রক্তপাত হলে বা দুটি পিরিয়ডের মাঝে প্রায়ই রক্তপাত হলে তা চিকিৎসককে জানান।

বাংলাদেশের সকল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সরকারি জেলা সদর হাসপাতাল, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, এমনকি নির্বাচিত কিছু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে, এনজিও ক্লিনিকগুলোতে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের পূর্বাবস্থা বোঝার এই ভায়া টেস্ট বিনামূল্যে করা হয়।

তাই অবহেলা বা সংকোচ না করে প্রতি ৫ বছর পরপর নিয়মিত জরায়ুমুখ ক্যান্সারের প্রাথমিক পরীক্ষা অর্থাৎ ভায়া টেস্ট করুন। জরায়ুমুখ ক্যান্সার থেকে নিরাপদ থাকুন।

জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রকাশ পেতে ১২ থেকে ১৫ বছরও সময় লেগে যেতে পারে; তাই এই রোগ থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে প্রতিষেধক ব্যবহার করা এবং প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করা। জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত হলে আতঙ্কিত না হয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করা।

https://bangla.minciter.com/2023/02/07/%e0%a6%85%e0%a6%a4%e0%a6%bf-%e0%a6%a6%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a4-%e0%a6%b6%e0%a6%bf%e0%a6%b6%e0%a7%81%e0%a6%95%e0%a7%87-%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ac/

Related Articles

Back to top button
error: