রোজা না রাখার হুকুম কি, কি কি কারনে রোজা রাখা যাবে না, রোজা না রাখার শাস্তি, যেসব পরিস্থিতিতে সাওম পালন নিষিদ্ধ, যেসব অবস্থায় রোজা না রাখার সুযোগ রয়েছে, যে সকল কারণে রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে ।
রোজা পালন করা সকল মুসলিম নারী-পুরুষের ওপর ফরজ। আল্লাহ তাআলা বলেছেন যে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেভাবে তোমাদের আগের লোকদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছিল। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)
তবে বিশেষ কয়েকটি অবস্থায় রোজা না রাখারও অনুমতি আছে তবে এসব কারণে রোজা না রাখলেও পরে তা আদায় করতে হবে।
যে সকল কারণে রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে
যেসব কারণে রমজানে রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে। আসুন সে কারণগুলো জেনে নিই-
১. মুসাফির– আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না। ’ -সূরা বাকারা : ১৮৫। মুসাফির (কমপক্ষে ৪৮ মাইল ভ্রমণ করেছেন যিনি) তার জন্য রোজা না রাখার অনুমতি আছে। তবে তার কষ্ট না হলে রোজা রাখা উত্তম।
২. অসুস্থ ব্যক্তি– অসুস্থতার কারণে রোজা রাখার শক্তি না থাকলে এবং রোজা রাখার কারণে কোনো জটিল রোগ সৃষ্টি বা পুরাতন রোগ বৃদ্ধির প্রবল আশংকা হলে, তার জন্য রোজা না রাখার অনুমতি আছে। সুস্থ হওয়ার পর তিনি কাজা করে নেবেন।
৩. দুর্বল ব্যক্তি– বার্ধক্যের কারণে রোজা রাখতে অক্ষম বা কোনো স্থায়ী জটিল রোগের কারণে রোজা রাখতে অক্ষম, ভবিষ্যতেও সুস্থতা লাভের সম্ভাবনা নেই তিনি ফিদিয়া (প্রতি রোজার জন্য পৌঁনে দুই সের গম বা তার মূল্য) আদায় করবেন। কিন্তু যদি পরবর্তীকালে কখনো সুস্থ হয়ে যান, তাহলে এ রোজাগুলোর কাজা করে নেয়া জরুরি। -সূরা বাকারা : ১৮৪; রদ্দুল মুহতার : ২/৪২৭; জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া : ১/১২০
৪. গর্ভবতী– গর্ভবর্তী মহিলা রোজা রাখলে যদি নিজের বা সন্তানের জীবনের ব্যাপারে আশঙ্কা করে তবে তিনি রোজা না করলেও চলবে। পরে তিনি কাজা করে নেবেন।
৫. দুগ্ধদানকারী নারী– যে মহিলা নিজের বা অন্যের বাচ্চাকে দুধ খাওয়ান, তিনি রোজা রাখলে যদি বাচ্চার কষ্ট হবে মনে করেন, তাহলে রোজা না রেখে পরে কাজা করতে পারবেন।
৬. ঋতুবর্তী মহিলা– মহিলাদের ঋতুকালীন সময়ে বা সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরবর্তী অসুস্থকালীন সময়ে রোজা করা যাবে না। তবে পরে কাজা করে নিতে হবে।
কি কি কারনে রোজা রাখা যাবে না বিস্তারিত
রমজান মাসের রোজার ফজিলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের সবাইকেই অবগত হওয়া প্রয়োজন, তবে কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে কিছু লোকের জন্য রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে। এখানে আমরা আলোচনা করব কাদের জন্য এবং কোন অবস্থায় রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে।
১. মুসাফির (ভ্রমণকারী)
আল্লাহতায়ালা বলেন: “আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে।” (সূরা বাকারা: ১৮৫)
মাসয়ালা:
- শরয়ি সফর (৪৮ মাইল বা ৭৭ কিলোমিটার) করলে রোজা না রাখার অনুমতি আছে। তবে কষ্ট কম হলে রোজা রাখা উত্তম।
- অস্বাভাবিক কষ্ট হলে রোজা রাখা মাকরুহ এবং পরবর্তীতে কাজা করতে হবে।
- সফর অবস্থায় রোজা রাখার নিয়ত করলে তা ভাঙা জায়েজ নয়।
- সাহরি খেয়ে সফর শুরু করলে রোজা ভাঙা জায়েজ নয়; এ ক্ষেত্রে গোনাহগার হতে হবে এবং কাজা ওয়াজিব হবে।
- যদি সফর শেষে মুকিম হয়ে যায়, তাহলে অবশিষ্ট সময় পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে।
২. অসুস্থ ব্যক্তি
মাসয়ালা:
- রোজা রাখার কারণে যদি কোনো জটিল রোগ সৃষ্টি হয় বা পুরাতন রোগ বৃদ্ধি পায়, তাহলে রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে। সুস্থ হওয়ার পর কাজা করতে হবে।
- শুধু খেয়ালের বশে রোজা ভেঙে ফেলা জায়েজ নয়; অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শের ভিত্তিতে রোজা ভাঙা যাবে।
- যদি কঠিন কাজ করার ফলে ভীষণ পিপাসার্ত হয়ে পড়েন এবং এতে প্রাণনাশের আশঙ্কা থাকে, তাহলে রোজা ভাঙা জায়েজ।
৩. দুর্বল ব্যক্তি
মাসয়ালা:
যে ব্যক্তি বার্ধক্যজনিত কারণে বা স্থায়ী জটিল রোগের কারণে রোজা রাখতে অক্ষম, ভবিষ্যতেও সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তিনি ফিদিয়া (প্রতি রোজার জন্য পৌনে দুই সের গম বা তার মূল্য) আদায় করবেন। যদি তিনি পরে সুস্থ হয়ে যান, তাহলে তার রোজার কাজা করা জরুরি।
(সূরা বাকারা: ১৮৪; রদ্দুল মুহতার: ২/৪২৭)
৪. গর্ভবতী মহিলা
মাসয়ালা:
গর্ভবতী মহিলার যদি রোজা রাখার কারণে নিজের বা সন্তানের প্রাণহানি বা মারাত্মক স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা থাকে, তবে তার জন্য রোজা ভাঙা জায়েজ। পরে তিনি এই রোজার কাজা করবেন।
(আল মুহিতুল বুরহানি: ৩/৩৫৯)
মাসয়ালা:
যদি রোজার কারণে দুগ্ধপোষ্য সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা হয়, তবে মা রোজা রাখবেন না।
(রদ্দুল মুহতার: ২/৪২২)
৫. দুগ্ধদানকারী নারী
মাসয়ালা:
যদি রোজার কারণে সন্তান দুধ না পেয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারে এমন আশঙ্কা থাকে, তবে দুগ্ধদানকারী মা রোজা ভাঙতে পারে এবং পরে কাজা করবে।
(রদ্দুল মুহতার: ২/৪২২)
৬. ঋতুবর্তী মহিলা
মাসয়ালা:
মাসিক ঋতুস্রাব (হায়েজ) এবং সন্তান জন্মদানের পরবর্তী ৪০ দিন (নেফাস) মহিলাদের জন্য রোজা বর্জন করা ওয়াজিব। এ অবস্থায় নামাজ ও রোজা কোনোটাই আদায় করা জায়েজ নয়। সুস্থ হওয়ার পর তাদের রোজার কাজা আদায় করতে হবে, তবে নামাজের কাজা আদায় করতে হবে না।
হজরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, “এ অবস্থায় আমাদের রোজার কাজা আদায় করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, নামাজের নয়।”
(সহিহ বোখারি ও মুসলিম)
রমজানের রোজা মুসলমানদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে আল্লাহ তাআলা কিছু সহজতা দিয়েছেন। অসুস্থতা, দুর্বলতা, গর্ভাবস্থা, ও ঋতুস্রাবের মতো পরিস্থিতিতে রোজা না রাখার সুযোগ রয়েছে, যা মুসলিমদের জন্য মহান রহমত।
রোজা কাজা করা ও নামাজ কাজা না করার বিধান
উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) জানিয়েছেন যে, মহিলাদের মাসিকের কারণে রোজার কাজা আদায় করতে হবে, কিন্তু নামাজের কাজা আদায় করতে হবে না। এই বিষয়ে উলামায়ে কেরামের ঐকমত্য (ইজমা) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
অবশিষ্ট সময় কাটানোর বিধান
১. অসুস্থতা বা বার্ধক্য: যিনি রমজানে রোজা রাখতে পারেন না, তিনি পানাহার করতে পারবেন, তবে রোজাদারদের অগোচরে এটি করা উচিত।
- মুসাফির: যদি মুসাফির দিনের বেলা সফর থেকে বাড়ি ফিরে আসে, তাহলে অবশিষ্ট সময় পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে।
- মহিলা: যদি দিনের বেলা কোনো মহিলার পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে তাকে অবশিষ্ট সময় পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে।
অক্ষম ব্যক্তিদের ফিদিয়া আদায়
ফিদিয়া হলো শারীরিক ইবাদত থেকে মুক্তির জন্য শরিয়তের নির্দেশিত বিনিময়। অসুস্থতা বা বার্ধক্যজনিত কারণে রোজা রাখতে অক্ষম ব্যক্তির জন্য ফিদিয়া দেয়ার বিধান রয়েছে।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে:
“আর যাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদিয়া— একজন দরিদ্রকে খাবার খাওয়ানো।” (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৫)
ফিদিয়া কখন দিতে হয়
- যদি অসুস্থ ব্যক্তি পরে সুস্থ হয়ে যায়, তাহলে তাকে কাজা আদায় করতে হবে এবং ফিদিয়া দিতে হবে না।
- অসুস্থ ব্যক্তি কাজা করার আগেই ইন্তেকাল করেন, তাহলে তার আত্মীয়দের ফিদিয়া আদায় করতে হবে।
- যদি কোনো ব্যক্তি রোজা রাখার ক্ষমতা ফিরে না পায়, তাহলে তাকে ফিদিয়া দিতে হবে।
ফিদিয়া দেওয়ার পরিমাণ
ফিদিয়ার পরিমাণ হলো একজন দরিদ্রকে খাবার খাওয়ানো। এটি সদকায়ে ফিতরের সমান।
কাকে ফিদিয়া দেওয়া যাবে?
ফিদিয়ার হকদার হলো গরিব-মিসকিনরা এবং এটি জাকাতের হকদারদেরকেও দেওয়া যেতে পারে।
একটি ভুল ধারণা
বদলি রোজার ধারণা ভুল। যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন, তবে তার জন্য অন্য কাউকে রোজা রাখতে দেওয়া যায় না; বরং ফিদিয়া আদায় করতে হবে।
এই বিষয়গুলো একজন মুসলিমের জন্য জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর মাধ্যমে রোজা রাখার বিধান ও পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
রমজান মাস: সংজ্ঞা ও গুরুত্ব
রমজান মাস হিজরি বছরের নবম মাস। মুসলমানদের কাছে এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই মাসে তারা ফরজ রোজা পালন করে। “রমজান” শব্দটি আরবি, যার মূল অর্থ হল প্রখর তাপ বা উত্তপ্ততা।
নামকরণের কারণ
রমজান মাসের নামকরণের পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে:
- জলবায়ুর প্রভাব: এই মাসে আরব দেশে সূর্যের উত্তাপ বেশি থাকে, তাই এটির নাম রমজান রাখা হয়েছে।
- রোজার ফরজ হওয়ার সময়: রোজা ফরজ হওয়ার সময় সূর্যের তাপের কারণে এ নামকরণ করা হয়েছে।
- আধ্যাত্মিক অর্থ: রোজা গুনাহগুলোকে “জ্বালিয়ে” দেয় বলে এই নামকরণ।
রমজান মাসের বৈশিষ্ট্য
রমজান মাসকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়, যেমন:
- شهر الصيام (সিয়াম-সাধনার মাস), شهر الصبر (ধৈর্যের মাস), شهر العتق من النيران (জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস), شهر القيام (রাত জাগার মাস), شهر الإحسان (অনুকম্পার মাস), شهر إجابة الدعاء (দোয়া কবুলের মাস)
শ্রেষ্ঠত্বের কারণ
রমজান মাসের শ্রেষ্ঠত্বের কিছু প্রমাণ:
- কোরআনের নাজিল: আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন যে রমজান মাসে কোরআন নাজিল করা হয়েছে (সুরা বাকারা: ১৮৫)।
- শবে কদরের মহিমা: শবে কদর, যা হাজার রাতের চেয়ে উত্তম (সুরা কদর: ১)।
- নবীজির হাদিস: হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, রমজান মাস হলো সমস্ত মাসের শ্রেষ্ঠ এবং এই মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়।
- অবস্থান ও ফজিলত: রমজান মাসে আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও মুক্তির সুযোগ পাওয়া যায়।
- রোজার প্রভাব: যদি মানুষ জানত রমজান মাসের কল্যাণ, তাহলে তারা চাইতো সারা বছর রমজান মাসই থাকুক।
শেষ কথা
রমজান মাস মুসলমানদের জন্য একটি পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ মাস। এই মাসের প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমত ও বরকত রয়েছে। রোজা রাখা ফরজ, এবং এটি আত্মশুদ্ধির, ধৈর্যধারণের ও আল্লাহর প্রতি নিবেদনের সময়।